মুক্তিযুদ্ধের নাতি নাতনি র সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা কত হয়ে থাকে? সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য যা দুই বছর বেশি। সরকারি যে কোনো দপ্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা ৩২ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন। তবে গত কয়েক বছরে সরকারি অন্তত ৩০টি দপ্তর ও সংস্থা বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টও। বিশেষ বয়সসীমা উল্লেখ না করায় আবেদন করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। বিশিষ্টজনরা বলছেন, বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর দপ্তর সংশ্লিষ্টদের কারও দাবি, বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ না থাকলেও আবেদন করা যেত।
বিষয়টি আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। শুধু সরকারি দপ্তর বা সংস্থা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে ৩ শতাংশ কোটাও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। ১৯৯৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (তখনকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয়) এক আদেশের মাধ্যমে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা অনুসরণ না করা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম-এর কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষার গত ৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম গ্রেড (প্রথম শ্রেণি), দশম থেকে ১৩তম গ্রেডে (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) সরাসরি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর পর থেকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর বিভিন্ন অজুহাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর অনুসরণ করছে না। অথচ কোটা ব্যবস্থা বাতিলের সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার কোনো সম্পর্ক নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৯৯৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এক আদেশের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশকালে বয়সের উচ্চসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করে চিঠিতে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনা থাকার পরও সরকারি বিভিন্ন দপ্তর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অনুসরণ করছে না,
যা সরকারি আদেশ অবমাননার শামিল। বয়স অনুসরণ না করায় অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানই চাকরির আবেদন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ অবস্থায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত ও জাতীয়করণ করা প্রতিষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অনুসরণের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় ওই চিঠিতে।
চিঠিটি সংযুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ২০ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি পাঠায়। সেখানে জনপ্রশাসন সচিবের উদ্দেশ্যে বলা হয়, প্রাপ্ত আবেদনখানা সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হলো। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো ব্যত্যয় (চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা মানার বিষয়ে) হয়ে থাকলে আমরা ইনশাআল্লাহ ব্যবস্থা নেবো। আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘যে সব সরকারি সংস্থা নিয়োগের ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বয়সসীমার বিষয়টি মানে না, তাদের এ বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে আনা হবে। সরকারি দপ্তর ও সংস্থাগুলো আইন অনুযায়ী যাতে ব্যবস্থা নেয়, এজন্য যা যা প্রয়োজন সেই বিষয়ে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়স ৩২ বছর। এ বিষয়ে সার্কুলার রয়েছে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য পেলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করবো।’
যেসব দপ্তর-সংস্থা নিয়ম মানছে না গত ২৫ আগস্ট ৫৫০ জন ফায়ার ফাইটার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বয়সসীমা মানা হয়নি। গত বছরের ২৪ মার্চ আটটি পদে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। সেখানে তিনটি পদে অভিজ্ঞদের জন্য বয়সসীমা ৩৭ বছর নির্ধারণ করা হলেও বাকি চারটি পদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়।
কমপ্লেইন সুপারভাইজার পদে নিয়োগ দিতে গত বছরের ২৩ মার্চ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), সেখানেও বয়সসীমা ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়। গত ২ আগস্ট ১৬টি পদে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। প্রত্যেকটি পদের জন্য বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয় ৩০ বছর। বার্তাবাহক পদে নিয়োগ দিতে গত ২১ আগস্ট মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ কার্যালয় তারা প্রার্থীদের বয়স নির্ধারণ করে ১৮ থেকে ৩০ বছর।
এভাবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের জন্য বয়সসীমা ৩২ বছর উল্লেখ না করে গত বছরের ১৮ জুলাই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালের সালের ২৭ মে ও ২০২০ সালের ২৮ জুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট, গত বছরের ২৫ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঢাকা শিশু হাসপাতাল (বর্তমান নাম বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট), গত ৮ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
একইভাবে গত কয়েক বছরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা এড়িয়ে গেছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন, খুলনা শিপইয়ার্ড, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, ঢাকা ইপিজেড হাসপাতাল, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্ট্যাডিজ (বিআইআইএসএস)। নিয়োগে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা কেন মানা হয়নি- জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মুহ. মাহবুবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই বিজ্ঞপ্তির কোথাও লেখা আছে, আপনি মনোযোগ দিয়ে দেখুন।’
‘সরকারি নির্দেশ থাকলে সরকারি কর্মচারীরা তো বটেই, আমরা সবাই সেটা মানতে বাধ্য। যদি তারা এটা ইচ্ছাকৃতভাবে মেনে না নেন এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ ভালোভাবেই দেখা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘এটা তো সরকারি স্ট্যান্ডিং অর্ডার। আমরা যদি নাও লিখে থাকি, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা ৩২ বছর বিবেচনা করে আবেদন করতে পারবেন। সমস্যা নেই, আমরা গ্রহণ করবো।’
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক (নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় দায়িত্বে থাকা) অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়গুলো আমরা সব সময় মেনে চলেছি।’ গত বছরের ২৫ আগস্ট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘এই নিয়োগটা মূলত আমরা দিয়েছি আমাদের এখানে ইন্টারনালি যারা কাজ করছিল তাদের জন্য। তারা মূলত এখানে দীর্ঘদিন অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করছিল। তাদের রেগুলারাইজ করার জন্য ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি দেওয়া হয়েছিল।
মানবিক কারণে এটা করতে হয়।’ ‘তাও মাত্র কয়েকজন টেকনিশিয়ানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, বাকিদের নিয়োগ দেওয়া যায়নি। আর বাইরে থেকে কাউকে তো নিয়োগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এর আগে যখন নিয়োগ দিয়েছি আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা মেনেছি’ বলেন সফি আহমেদ।
খুবই যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলাম সেই বৈষম্য যেন ফিরে এসেছিল এই কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর সৈনিকদের আমরা কখোনই ভুলব না। তাদের অনেকভাবে সম্মান করা যায়। কিন্তু তাদের সন্তানদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পিছনে কোন যুক্তি খুজে পাই না। সন্তানের অবদান কি শুধুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া? এটা তো হল তাহলে”জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো”এর বিপরীত।