মাইকেল মধুসূদন দত্ত
➡️১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে জানুয়ারী জন্ম।
➡️তিনি ২৯ শে জুন ১৮৭৩ সালে কলকাতার আলীপুর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেণ।
➡️বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি।
➡️বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি।
➡️অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক।
➡️বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং একমাত্র পত্রকাব্য রচয়িতা।
➡️বাংলা সাহিত্যের সার্থক ট্রাজেডি নাটক রচয়িতা।
➡️বাংলা সাহিত্যের সার্থক মহাকাব্য রচয়িতা।
➡️বাঙ্গালী হিসেবে তিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য পোষাক পরিধান করেন।
➡️১৮৪৩ সালে তিনি ওল্ড মিশন চার্চে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করেন।
➡️তাঁর প্রথম প্রকাশিত নাটক শর্মিষ্ঠা।
➡️তিনি দুটি প্রহসন লিখেন।
➡️তিলোত্তমাসসম্ভব কাব্য, প্রকাশকাল ১৮৬০, স্বর্গ সংখ্যা ৫।এই কাব্যে তিনি সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ করেন।
➡️বীরাঙ্গনা কাব্য, প্রকাশকাল ১৮৬২।এটি পত্রকাব্য। পত্রের সংখ্যা ১১।রোমান কবি অভিদেবের হেরোদাইস কা্ব্য অনুসারে রচিত।
➡️ব্রজাঙ্গনা কাব্য হল গীতিকাব্য। এর প্রতিপাদ্য কৃষ্ণের প্রেম।
➡️কৃষ্ণকুমারী নাটকের প্রকাশকাল ১৮৬১ সাল। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্রাজেডি নাটক। উল্লেখযোগ্য চরিত্র কৃষ্ণকুমারী, মদনিকা, ভীমসিংহ, জগৎসিংহ ও ধনদাস।
➡️পদ্মাবতী নাটকের প্রকাশকাল ১৮৬০ সাল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সর্বপ্রথম এই নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ ঘটান।
⏺️গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন
⏺️ জন্মঃ ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে যশাের জেলার কপােতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাড়ী গ্রামে
⏺️মৃত্যুঃ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় (৪৯ বয়স)
⏺️ খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেন। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৯ বছর বয়স)
⏺️ কত সালে মেঘনাদবধ কাব্য প্রথম প্রকাশিত হয়?- ১৮৬১
⏺️কোনটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পত্রকাব্য? বীরাঙ্গনা
⏺️ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ট্রাজেডি নাটক কোনটি?- কৃষ্ণকুমারী
⏺️১।মেঘনাদবধ কাব্য: এটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক রচিত বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এ মহাকাব্যের সর্গ সংখ্যা ৯টি। এই মহাকাব্যের কাহিনির উৎস সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ । এটি একটি বীর রসের কাব্য।
২। বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কবে প্রকাশিত হয়?
উঃ ১৮৬১ সালে।
৩। হেক্টরবধ: এটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক মহাকবি হােমারের ইলিয়াড-এর বঙ্গানুবাদ। এটি একটি অসমাপ্ত বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ।
৪। কাব্যগ্রন্থ: ‘The Captive Lady’ তাঁর লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ তবে এটি বাংলা ভাষায় নয় ইংরেজি ভাষায় রচিত।
৫। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনটি?
উঃ তিলােত্তমাসম্ভব (১৮৬০ সালে প্রকাশিত)
৬। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলাে কি কি?
উ: তিলােত্তমাসম্ভব। এটি বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত প্রথম গ্রন্থ। এটি একটি কাহিনি কাব্য। তিনি ‘পদ্মাবতী নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রয়ােগ করলেও “তিলােত্তমাসম্ভব’ কাব্যগ্রন্থই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ।
৭। চতুর্দশপদী কবিতাবলী: বাংলা সাহিত্যর প্রথম সনেট সংকলন। তিনি ইতালীয় কবি পেত্রার্ক ও শেক্সপিয়রের অনুকরণে এসব সনেট রচনা করেন।
৮। বীরাঙ্গনা: এটি বাংলা সাহিত্যর প্রথম পত্রকাব্য। (নােট: তবে আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলা সাহিত্যর প্রথম পত্রোপন্যাস হলাে কজী নজরুল কর্তৃক রচিত ‘বাঁধন-হারা উপন্যাসটি)
৯। ব্রজাঙ্গনা: এটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক রচিত রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক একটি গীতিকাব্য। এই গ্রন্থটিকে বৈষ্ণব পদাবলীর আধুনিক পরিণতি বলা হয়।
১০। শর্মিষ্ঠা (১৮৫৮)-বাংলা সাহিত্যর প্রথম সার্থক নাটক।
১১। কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যর প্রথম সার্থক ট্রাজেডি নাটক।
১২। পদ্মাবতী- বাংলা সাহিত্যর প্রথম সার্থক কমেডি নাটক।
১৩। মায়াকানন- মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচিত একটি নাটক।
১৪। প্রহসনঃ বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রোঁ (বাংলা সাহিত্যর প্রথম প্রহসন), একেই কি বলে সভ্যতা।
১৫। বঙ্গভাষা- কবিতা টি বাংলা সাহিত্যর প্রথম সনেট।
১৬। কপােতাক্ষ নদ- একটি সনেট জাতীয় কবিতা। ‘চতুর্দশ কবিতাবলী কাব্য গ্রন্থের অন্তর্গত।
১৭।প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাট্যকার কে?
উ: মাইকেল মধুসূদন দত্ত। (নােট: তবে বাংলা সাহিত্যে নাটকের জনক হলেন- দীনবন্ধু মিত্র)
১৮।প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক নাট্যকার কে?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত। (নােট: তবে বাংলাদেশে নতুন ধারার নাটকের পথিকৃৎ বলা হয়- সেলিম আল দীনকে)
১৯।প্রশ্ন: বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের পথিকৃৎ বলা হয় কাকে?
উ: মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
২০।প্রশ্নঃ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক কোনটি?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী।
২১। প্রশ্ন: মাইকেল মধুসূদন দত্তের ঐতিহাসিক নাটক কোনটি?
উ: কৃষকুমারী ।
২২। প্রশ্ন: মাইকেল মধুসূদন দত্ত দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে কী নামে অনুবাদ করেন?
উ: The Indigo Planting Mirror’ নামে অনুবাদ করেন। এখানে। উল্লেখ্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকটি অনুবাদ করার সময় নিজের মূল নাম ব্যবহার না করে A Native’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি মঞ্চস্থিত হলে এই নাটকের অভিনয় দেখতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নাটকের অভিনেতাকে জুতাে মেরেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নীলদর্পণ’ নাটকটিকে ইংরেজি সাহিত্যের Harriet Beecher Stowe-97 Uncle Tom’s Cabin এর সাথে তুলনা করেছেন। [এখানে উল্লেখ্য যে, মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন ইংরেজি সাহিত্যের কবি লর্ড বায়রন ও তাঁর সাহিত্যকর্ম।]
⏺️বিস্তারিত আলোচনা
মাইকেল মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩) মহাকবি, নাট্যকার, বাংলাভাষার সনেট প্রবর্তক, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে, এক জমিদার বংশে তাঁর জন্ম। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল। মা জাহ্নবী দেবীর তত্ত্বাবধানে মধুসূদনের শিক্ষারম্ভ হয়। প্রথমে তিনি সাগরদাঁড়ির পাঠশালায় পড়াশোনা করেন। পরে সাত বছর বয়সে তিনি কলকাতা যান এবং খিদিরপুর স্কুলে দুবছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন।
হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালেই মধুসূদনের প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ১৮৩৪ সালে তিনি কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইংরেজি ‘নাট্য-বিষয়ক প্রস্তাব’ আবৃত্তি করে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ, যাঁরা পরবর্তী জীবনে স্বস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মধুসূদন উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কলেজের পরীক্ষায় তিনি বরাবর বৃত্তি পেতেন। এ সময় নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন।
হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময়েই মধুসূদন কাব্যচর্চা শুরু করেন। তখন তাঁর কবিতা জ্ঞানান্বেষণ, Bengal Spectator, Literary Gleamer, Calcutta Library Gazette, Literary Blossom, Comet প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
এ সময় থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন বিলেত যাওয়ার। তাঁর ধারণা ছিল বিলেতে যেতে পারলেই বড় কবি হওয়া যাবে। তাই পিতা তাঁর বিবাহ ঠিক করলে তিনি ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গ্রহণ করেন এবং তখন থেকে তাঁর নামের পূর্বে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়। কিন্তু হিন্দু কলেজে খ্রিস্টানদের অধ্যয়ন নিষিদ্ধ থাকায় মধুসূদনকে কলেজ ত্যাগ করতে হয়। তাই ১৮৪৪ সালে তিনি বিশপ্স কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪৭ পর্যন্ত এখানে অধ্যয়ন করেন। এখানে তিনি ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখার সুযোগ পান।
এ সময় ধর্মান্তরের কারণে মধুসূদন তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর পিতাও এক সময় অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন। অগত্যা মধুসূদন ভাগ্যান্বেষণে ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ গমন করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। প্রথমে মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে (১৮৪৮-১৮৫২) এবং পরে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা (১৮৫২-১৮৫৬) করেন।
মাদ্রাজের সঙ্গে মধুসূদনের জীবনের অনেক ঘটনা জড়িত। এখানেই তিনি সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি Eurasion (পরে Eastern Guardian), Madras Circulator and General Chronicle ও Hindu Chronicle পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং Madras Spectator-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন (১৮৪৮-১৮৫৬)। মাদ্রাজে অবস্থানকালেই Timothy Penpoem ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Captive Ladie (১৮৪৮) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ Visions of the Past প্রকাশিত হয়। রেবেকা ও হেনরিয়েটার সঙ্গে তাঁর যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বিবাহ এখানেই সংঘটিত হয়। মাদ্রাজে বসেই তিনি হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা শিক্ষা করেন।
এরমধ্যে মধুসূদনের পিতামাতা উভয়ের মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটাকে নিয়ে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা আসেন। সেখানে তিনি প্রথমে পুলিশ কোর্টের কেরানি এবং পরে দোভাষীর কাজ করেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেও তিনি প্রচুর অর্থোপার্জন করেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবরা এ সময় তাঁকে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতে অনুরোধ জানান এবং তিনি নিজেও ভেতর থেকে এরূপ একটি তাগিদ অনুভব করেন। রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী (১৮৫৮) নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করেন এবং তাঁর মধ্যে তখন বাংলায় নাটক রচনার সংকল্প জাগে। এই সূত্রে তিনি কলকাতার পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এমন একটি পরিস্থিতিতে নাট্যকার হিসেবেই মধুসূদনের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পণ ঘটে। তিনি মহাভারতের দেবযানী-যযাতি কাহিনী অবলম্বনে ১৮৫৮ সালে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন শর্মিষ্ঠা নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক এবং একই অর্থে মধুসূদনও বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার।
পরের বছর মধুসূদন রচনা করেন দুটি প্রহসন: একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। প্রথমটিতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত ইয়ং বেঙ্গলদের মাদকাসক্তি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন এবং দ্বিতীয়টিতে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আচারসর্বস্ব ও নীতিভ্রষ্ট সমাজপতিদের গোপন লাম্পট্য তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রেও মধুসূদন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রহসন দুটি কাহিনী, সংলাপ ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে আজও অতুলনীয়।
মধুসূদনের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি যাকিছু রচনা করেছেন তাতেই নতুনত্ব এনেছেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন। তখনকার বাংলা সাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং বিষয়ভাবনাগত যে আড়ষ্টতা ছিল, মধুসূদন তা অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতাগুণে দূরীভূত করেন। ১৮৬০ সালে তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে কাহিনী নিয়ে রচনা করেন পদ্মাবতী নাটক। এ নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার বরেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার এটাই প্রথম এবং এর ফলে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারে এই সফলতা তাঁকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে এবং এই ছন্দে একই বছর তিনি রচনা করেন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। পরের বছর ১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনী নিয়ে একই ছন্দে তিনি রচনা করেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি । এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। আর কোন রচনা না থাকলেও মধুসূদন এই একটি কাব্য লিখেই অমর হয়ে থাকতে পারতেন। এই কাব্যের মাধ্যমেই তিনি মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রামায়ণে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক, বীর যোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধাররূপে চিত্রিত করে মধুসূদন উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে প্রকৃত সত্য সন্ধান ও দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, বাংলা সাহিত্যে তা তুলনাহীন।
মধুসূদনের কাব্যে এক ধরনের নারীবিদ্রোহের সুর লক্ষ করা যায়। তাঁর কাব্যের নায়িকাদের মধ্য দিয়ে যেন যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবহেলিত, আত্ম সুখ-দুঃখ প্রকাশে অনভ্যস্ত ও ভীত ভারতীয় নারীরা হঠাৎ আত্মসচেতন হয়ে জেগে ওঠে। তারা পুরুষের নিকট নিজেদের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ এবং কামনা-বাসনা প্রকাশে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। তাঁর বীরাঙ্গনা (১৮৬২) পত্রকাব্যের নায়িকাদের দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যাবে। এখানে জনা, কৈকেয়ী, তারা প্রমুখ পৌরাণিক নারী তাদের স্বামী বা প্রেমিকদের নিকট নিজেদের কামনা-বাসনা ও চাওয়া-পাওয়ার কথা নির্ভীকচিত্তে প্রকাশ করে। নারীচরিত্রে এরূপ দৃঢ়তার প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে আর কারও রচনায় প্রত্যক্ষ করা যায় না। মধুসূদনের এ সময়কার অপর দুটি রচনা হলো কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) ও ব্রজাঙ্গনা (১৮৬১)। প্রথমটি রাজপুত উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত একটি বিয়োগান্তক নাটক এবং দ্বিতীয়টি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গীতিকাব্য। এ পর্বে মধুসূদন দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং কিছুদিন হিন্দু প্যাট্রিয়ট (১৮৬২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৮৬২ সালের ৯জুন মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যান এবং গ্রেজ-ইন-এ যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৮৬৩ সালে তিনি প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান এবং সেখানে প্রায় দুবছর অবস্থান করেন। ভার্সাইতে অবস্থানকালে তাঁর জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এখানে বসেই তিনি ইতালীয় কবি পেত্রার্কের অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন। বাংলা ভাষায় এটিও এক বিস্ময়কর নতুন সৃষ্টি। এর আগে বাংলা ভাষায় সনেটের প্রচলন ছিল না। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ভার্সাই নগরীতে থেকেই তিনি যেন মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে নতুনভাবে এবং একান্ত আপনভাবে দেখতে ও বুঝতে পারেন, যার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ‘বঙ্গভাষা’, ‘কপোতাক্ষ নদ’ ইত্যাদি সনেটে। তাঁর এই সনেটগুলি ১৮৬৬ সালে চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী নামে প্রকাশিত হয়।
ভার্সাই নগরীতে দুবছর থাকার পর মধুসূদন ১৮৬৫ সালে পুনরায় ইংল্যান্ড যান এবং ১৮৬৬ সালে গ্রেজ-ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। কিন্তু ওকালতিতে সুবিধে করতে না পেরে ১৮৭০ সালের জুন মাসে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন। দুবছর পর এ চাকরি ছেড়ে তিনি পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবারে তিনি সফল হন, কিন্তু অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অমিতব্যয়িতার ব্যাপারটি ছিল তাঁর স্বভাবগত। একই কারণে তিনি বিদেশে অবস্থানকালেও একবার বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে সেবার উদ্ধার পান। ১৮৭২ সালে মধুসূদন কিছুদিন পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহ দেও-এর ম্যানেজার ছিলেন।
জীবনের এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েও মধুসূদন কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। হোমারের ইলিয়াড অবলম্বনে ১৮৭১ সালে তিনি রচনা করেন হেক্টরবধ। তাঁর শেষ রচনা মায়াকানন (১৮৭৩) নাটক। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর ১২টি গ্রন্থ এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ রয়েছে।
মধুসূদন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি। তিনি তাঁর কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত সংস্কৃত কাব্য থেকে, কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ অনুযায়ী সমকালীন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির জীবনদর্শন ও রুচির উপযোগী করে তিনি তা কাব্যে রূপায়িত করেন এবং তার মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মধুসূদন তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভার দ্বারা বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে এই ভাষা ও সাহিত্যের যে উৎকর্ষ সাধন করেন, এরফলেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘মধুকবি’ নামে পরিচিত।
বাংলার এই মহান কবির শেষজীবন অত্যন্ত দুঃখ-দারিদ্রে্যর মধ্যে কেটেছে। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিনদিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন বাংলার এই মহা কবি কপর্দকহীন অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
➡️ সংকলন-মোস্তাফিজার মোস্তাক