ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে উত্তেজনা চরমে আর এরই মধ্যে চলছে নানা ধরণের নির্যাতন নিপীড়ন। শিশু, যুবক, কিংবা বৃদ্ধ- ঘর থেকে বের হলেই চোখ-মুখ লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ছোড়া হচ্ছে গুলি।
এখানেই শেষ নয়, কয়েক হাজার কিশোরকে আটক করেছে, সুযোগ বুঝে বাড়ি তল্লাশির নামে বহু নারী ও অল্প বয়সী কিশোরীদেরও যৌন হয়রানি করছে ভারতীয় সেনারা বলে অভিযোগ করেছে নয়াদিল্লিভিত্তিক কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা।
মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) নিউ ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ও হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। স্বায়ত্তশাসন বাতিলের একদিন পর (৬ আগস্ট) ছররা গুলিতে গুরুতর আহত হন ১৬ বছর বয়সী কিশোর আসরার আহমেদ। বাড়ির বাইরে বের হলে সেনারা তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে।
এতে তার মাথা, চোখ, কাঁধ ও মুখে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ১৫ দিন ধরে শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সাইন্সেস (এসকেআইএমএস) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে ছররা গুলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে আহমেদ বলেন, ‘একটা বল আনতে বাড়ির প্রধান ফটকের বাইরে বের হই আমি।
এদিকে নতুন করে আহত হয়েছেন অনেকেই। অন্ধ হয়েছেন বেশ কয়েকজন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন কেউ কেউ। গুরুতর আহত হলেও অনেকেরই চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কোনো রকম উসকানি ছাড়াই তাদের দিকে ‘পেলেট গান’ তাক করা হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে ঠিক কতজন ছররা গুলিতে আহত হয়েছেন, তা নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ঠিক তখনই কিছু দূরে দাঁড়ানো সেনারা প্রথমে আমার দিকে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে মারে। পরপরই আমার চোখে ও মুখে ছররা গুলি ফায়ার করে।’ ছররা গুলিতে আহতদের চিকিৎসার জন্য শ্রীনগরের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতালে (এসএমএইচএস) চক্ষু বিভাগ খোলা হয়েছে।
প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে এখানে। এখন অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। শ্রীনগর পুরনো শহরের বাসিন্দা সামির হোসেন তাদেরই একজন। একটি ওষুধের দোকান চালান হোসেন। তিনি জানান, গত শনিবার ছররা গুলি লাগে তার।
ওই সময় নিজের ওষুধের দোকান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সেদিনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাম চোখে এসে লাগে গুলি। দোকান থেকে ফেরার পথে পুলিশ গুলি চালায়। আমি ঠিক জানি না, তারা কেন আমার দিকে তাক করল।’
সামির হোসেনের বিছানার পাশেই যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন ৭৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ সাদিক। তার চোখেও ছররা গুলি লেগেছে। সাদিক বলছিলেন, ‘মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘরে ফিরছিলাম আমি।
ওই সময় মসজিদের কাছেই কিছু মানুষ বিক্ষোভ করছিল। তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। আমি বিক্ষোভে অংশ নিইনি। কিন্তু আমাকেও গুলি করা হয়েছে।’
হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে ছররা গুলির রোগীর ভিড় থাকলেও এ পর্যন্ত ঠিক কতজন চিকিৎসা নিয়েছেন, সে ব্যাপারে একেবারে নীরব রয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ইতিপূর্বে হাসপাতালের স্টাফরাও ছররা গুলির রোগীর ব্যাপারে সহজেই তথ্য দিতেন।
কিন্তু এখন একেবারেই চুপ। রোগীদের দর্শনার্থীদের ওপর কড়া নজর রাখছে পুলিশ। রাতে দায়িত্ব পালন করা চক্ষু বিভাগের এক ডাক্তারের সঙ্গে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ওয়ার্ডে বর্তমানে ঠিক কতজন রোগী ভর্তি আছেন তা তিনি জানেন না।
সিনিয়র ডাক্তারদের থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার এখতিয়ার নেই আমাদের।’ বিক্ষোভ রুখতে ২০১০ সাল থেকে পেলেট গান (এক ধরনের অস্ত্র) ব্যবহার করছে বাহিনী।
ভারতে শুধু কাশ্মীরেই এই পেলেট গান ব্যবহার করা হচ্ছে। বন্দুকের গুলির মতো মারণাস্ত্র নয় এ ছররা। একেকটি শেলের মধ্যে ছোট ছোট পাঁচ শতাধিক লোহার বল থাকে। বন্দুক থেকে এই শেল ছোড়া হলে বাইরের খোলস ফেটে বলগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, কাশ্মীর সরকারের এক তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে আট শতাধিক কাশ্মীরি চোখে আহত হন। তবে পিলেট ভিকটিম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মতে, ২০১৭ সালে ১২০০-এর বেশি নারী, পুরুষ ও শিশুর চোখে ছররার গুলি লাগে।
এর মধ্যে শতাধিক কাশ্মীরির এক বা উভয় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালকে তো ‘গণ-অন্ধত্ব বছর’ বলা হয়ে থাকে। ওই বছরের ৮ জুলাই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বুরহান ওয়ানির হত্যার পর উত্তপ্ত কাশ্মীরে ১১০০ জনের চোখে ছররা ঢোকে।